নাটোর জিলার সিংড়া থানাস্থ হুলহুলিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩১ ইং সনের ১ লা জানুয়ারী তারিখে জনাব এম এম রহমত উল্লাহ্ সাহেব জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ রহিম উদ্দিন মন্ডল এবং মাতা মোসাম্মাৎ সারাহ জাহান।
জনাব এম এম রহমত উল্লাহ সাহেব, উনার প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু করেন। প্রাথমিক শিক্ষাশেষে উনি উক্ত এলাকায় অবস্থিত বিশ^কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠি বাড়ী পতিসরে রবিঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘‘রথিন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চ বিদ্যালয়” এ কিছুদিন শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ‘‘বগুড়া জিলা স্কুলে” ৭ম শ্রেণীতে ভর্তী হন এবং উক্ত বিদ্যালয় হইতে ১ম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা শেষে জনাব রহমত উল্লাহ সাহেব ‘‘রাজশাহী সরকারী মহাবিদ্যালয়” হইতে কৃতিত্তের সহিত বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর উনি ঢাকায় অবস্থিত তৎকালীণ আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারীং কলেজ এ (বর্তমানে “বুয়েট”) ভর্ত্তী হন। উক্ত ইঞ্জিনিয়ারীং কলেজ হইতে ১৯৫৪ ইং সনে কৃতিত্তের সহিত ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। জনাব রহমত উল্লাহ্ সাহেব ছাত্র হিসাবে খুবই মেধারী ছিলেন।
পড়াশুনা শেষে, উনি তৎকালীন পাকিস্তানের ‘‘সি এন্ড বি’’ বিভাগে (বর্তমানে গণপূর্ত বিভাগ) চাকুরীতে যোগদান করেন। তাঁর বর্ণাঢ্য চাকুরী জীবন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী বহু উন্নয়ণ মূলক কার্যক্রমের সাথে মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে সার্বিক তত্ত¡াধানে জড়িত ছিলেন। যেমন,
(ক) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হাউজ (বর্তমানে বঙ্গভবন) ‘টিকে বর্তমানরূপে পূনঃ নির্মাণ কাজটি সম্পূর্ণ রূপে তাঁর তত্ত¡বধানে নির্মিত হয়।
(খ) ‘ঐ একই সময়ে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজধানী রাওয়াল পিন্ডিতে অবস্থিত ‘‘ইষ্ট পাকিস্তান হাউজ’’ টি ও তাঁর সার্বিক তত্ত¡াবধানে নির্মিত হয়।
(গ) তাঁর নিজস্ব প্রচেষ্টা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সুপারিশে পাকিস্তান সরকার নাটোরের দিঘাপতিয়ায় অবস্থিত ‘‘নাটোর মহারাজার’’ বিশাল রাজ প্রাসাদটিকে ‘‘উত্তরা গণভবন’’ হিসাবে ঘোষণা দেন।
(ঘ) তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান এর নতুন হাইকোর্ট বিলডিংটির ৪র্থ তলা নির্মাণ সহ সম্পূর্ণ হাইকোর্ট চত্বর কমপ্লেক্সটি তাঁর সার্বিক তত্বাবধানে নির্মিত হয়।
(ঙ) জনাব রহমত উল্লাহ্ সাহেবের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে যশোর খুলনা অঞ্চলে নির্বাহী ও তত্বাবধায়ক ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার সামগ্রীক উন্নতির লক্ষ্যে তার অবদান অনিস্বীকার্য। তাঁর সার্বিক তত্বাবধানে নির্মিত কমপ্লেক্সগুলির মধ্যে- যশোর, এডুকেশন বোর্ড অফিস, খুলনা, ফায়ার সার্ভিস বিল্ডিং, সরকারী মন্নুজান বালিকা বিদ্যালয় শেষ পর্যায়ের নির্মাণ। মনিরামপুর হেলথ কমপ্লেক্স এবং উক্ত এলাকা সমূহে অবস্থিত সরকারী সংস্থার ভবনগুলি নির্মাণ।
স্বাধীনতা পরবর্তী কালে তিনি কিছুদিন ‘‘বাংলাদেশ ওয়্যার হাউজ করর্পোরেশন’’ এর প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
‘‘ওয়্যার হাউজ করর্পোরেশন’’ এর চাকুরীর মেয়াদ শেষে তিনি গণপূর্ত বিভাগে ফিরে আসেন এবং কিছুদিন পর গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী হিাসবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে, তিনি, বাংলাদেশের ৬৮ টি জিলার, নূতন স্থাপিত জিলাগুলি সহ সমগ্র বাংলাদেশে গণপূর্ত বিভাগের ব্যাপক কার্যক্রম এর সুবিধার্থে নূতন স্বংস্থাপন ও প্রয়োজনীয় কাঠামো গঠন তার ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টায় সম্ভব হইয়াছে। যেমন নতুন জিলাগুলির প্রশাসনিক ভবনসহ, সার্কিট হাউজসহ সকল সরকারী স্থাপনাগুলি।
ইহা ছাড়া সকল নূতন জিলাগুলির সরকারী সংস্থাপন গুলির প্রয়োজনে ভৌত অবকাঠামোগুলি নির্মাণে তাঁর অবদান অনিস্বীকার্য। গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে চাকুরী হইতে অবসর গ্রহণের পর, তাঁর কর্মদক্ষতার কারণে তাঁকে ‘‘ডিজি’’ ‘‘বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর’’ হিসাবে পূনঃ নিয়োগ প্রদান করেন। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর এর কার্যক্রম আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য গৃহিত পদক্ষেপটিও জনাব রহমত উল্লাহ্ সাহেবের কর্মজীবনের একটি অনন্য উদাহরণ।
পরিবেশ অধিদপ্তর এর কার্যক্রম শেষে সরকার তাহাকে ‘‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের’’ চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেন। চেয়ারম্যান, ‘‘রাজউক’’ হিসাবে তাঁর প্রধান অবদান গুলির মধ্যে উল্লেক্ষ্যযোগ্য, ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে নূতন রাস্তা নির্মাণ যেমন পান্থপথ, বিজয় স্মরনী, বিশ^রোড এবং ঢাকা নারায়নগঞ্জ স্বাধীনতা স্মরনী এবং পূরাতন রাস্তাগুলি বিশেষভাবে পূরাতন ঢাকার রাস্তা গুলি প্রসস্ত করণ তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার সফলতার ফল।
ব্যক্তিগত জীবনে জনাব রহমত উল্লাহ্ সাহেব খুবই শিক্ষা অনুরাগী ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানের সময় নাটোর জিলার সিংড়া থানা এলাকাসহ পাশর্^বর্তী এলাকাগুলি চলাচলের জন্য খুবই দূর্গম এবং অনঅগ্রসর এলাকা হিসাবে কোন উচ্চ শিক্ষার ব্যাবস্থা ছিল না। সেই অভাব পূরনের জন্য তিনি, ১৯৭০ইং সনে স্থানীয় গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় সিংড়া থানা সদরে “গোল-ই-আফরোজ হেনা” কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে উক্ত কলেজটি “সরকারী গোল-ই-আফরোজ হেনা ইউনিভার্সিটি কলেজ” হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে।
ছোট বাচ্চাদের আধুনিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করার লক্ষ্যে সিংড়া থানা সদরে ১৯৮০ইং সালে ‘‘রহিম ইকবাল কেজি একাডেমী’’, নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
সিংড়া থানার প্রত্যন্ত দূর্গম এলাকায় কালীগঞ্জ এর অবস্থান। উক্ত এলাকার ছাত্র/ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য জনাব রহমত উল্লাহ, সাহেব ১৯৯০ইং সালে “রহিম উদ্দিন ডিগ্রী কলেজ’’ নামক একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
সিংড়া থানার প্রত্যন্ত দূর্গম এলাকা “বামিহালে” ‘‘রহমত ইকবাল অনার্স কলেজ” নামে ১৯৯০ইং সালে আরও একটি কলেজ স্থাপন করেন।
জনদরদী জনাব রহমত উল্লাহ সাহেব তার এলাকার বহু শিক্ষিত যুবক/যুবতির কর্মস্থানের ব্যবস্থা করেছেন এবং উচ্চশিক্ষা শিক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেছেন, যাহারা এখন তাদের নিজ নিজ জীবনে সুপ্রতিষ্টিত।
ব্যক্তি, রহমত উল্লাহ সাহেব একজন খুবই সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন। তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস, নাটক ও কবিতা সুধিজন দ্বারা এখনও সমাদৃত। গীতিকার হিসাবে তিনি তৎকালীন সময়ে সু-প্রশিদ্ধ ছিলেন। তাঁর লেখাগুলির মধ্যেঃ প্রলয়বীনা, কলস্বন, নাটক বিজয়ী নাটক ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি স্ত্রী গোল-ই-আফরোজ হেনা সহ তিন ছেলে ও চার মেয়ের গর্বিত পিতা। উনার সকল সন্তানগণ মেধাবী, শিক্ষিত এবং সুপ্রতিষ্টিত।
জনাব রহমত উল্লাহ সাহেব, ২৯শে নভেম্বর ২০১৩ইং সনে না ফেরার দেশে গমন করেন। আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁর রুহের মাগফিরাত করেন।