উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তিত্ব

মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ “হেড পন্ডিত” (১৯১৪ – ১৯৮৯)

বাংলাদেশের রুপকথার গ্রাম নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত হুলহুলিয়া ( Hulhulia) গ্রামের “হেড পন্ডিত” নামে খ্যাত জানাব মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর, রংপুর শহর হতে ভার্নাকুলার প্রশিক্ষণ নেন। বেশকিছু লোভনীয় চাকরি পেয়েও, কিছু দিন তা করার পর, পিতা গোলাম মহিউদ্দিন এর আহবানে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন এবং গ্রামে শিক্ষকতা শুরু করেন (যার সময়কাল দীর্ঘ প্রায় ৪৩ বছর)।

তিনি গ্রামে স্কুল এবং মসজিদ প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাহায্যের পাশাপাশি তাঁর একক প্রচেষ্টায় “দি ডায়মন্ড ক্লাব এন্ড লাইব্রেরি” প্রতিষ্ঠিত করেন (১৯৪২ সালে)[The Diamond Club and Library, 1942]। এই লাইব্রেরীতে প্রায় সাত হাজারের কাছাকাছি বই সংগৃহীত এবং সংরক্ষিত ছিল। এসব বইপত্রের মধ্যে অনেক বই ছিল যেগুলো প্রাচীন পান্ডুলিপি থেকে শুরু করে অনেক অমূল্য ইতিহাস ধারণ করে।

এ ছাড়াও শত বাধা উপেক্ষা করে মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ “হেড পন্ডিত” পোস্ট অফিস স্থাপন, গ্রামের মানুষের অসুখ-বিসুখের কথা মাথায় রেখে সরকারি ডিসপেন্সারি স্থাপন, গ্রামীণ বিচার ব্যবস্থা যা আজকের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামে পরিচিত, সহ একাধিক গ্রাম উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত ছিলেন। তখন তাঁর সাথে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন, ও বর্তমানের যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিগত প্রায় ১০০ বছর ধরে এই গ্রামের কোন মামলা মোকদ্দমা কখনোই থানা বা আদালতে যায়নি। এটি (গ্রামটি) এখন একটি “আদর্শ” গ্রাম নামে দেশে এবং বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে।

মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ, পতিসরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেন ১৯৩৭ সালে। যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে শেষবারের মতো আসেন তখন গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং শিক্ষাবিদদের তিনি ডেকেছিলেন। সেই সুবাদে মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ ওনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন অন্যান্যদের সঙ্গে করে এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে একটি স্কুল (যা কিনা এখন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত) স্থাপনের জন্য সুপারিশ করেন কালিগ্রাম নামের গ্রামটিতে। যখন বিশ্বকবি বিদায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ লাইনে দাঁড়িয়ে সবার সাথে কবিকে বিদায় জানিয়েছিলেন। “আমাদের ছোট নদী” কবিতাটি কবি পতিসরেই লিখেছিলেন।

মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ “হেড পন্ডিত”, পোরসা ও গোদাগাড়ীতে খুব সুনামের সাথে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। সেই সময় পোরসার জমিদার জিল্লুর রহমানের বাড়িতে লজিং থাকতেন। মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদের মুখে শোনা – তখন কাচি টাকার যুগ ছিল। বস্তা ভরে টাকা নিয়ে শ্রমিকরা চোখ বেঁধে অন্দরমহলে জমা দিতেন। দুইতলা ঘরে গরু রাখা হতো। জমিদারের বাড়িতে পাশের দেশ থেকে তখন ঘি এবং তেল আসতো এবং ওই ঘি এবং তেল ছাড়া জমিদার বাড়িতে কোন রান্না হতো না। অন্দরমহলের কেউ বাহির মহলে আসতে পারত না আর বাহির মহলের কেউ অন্দরমহলে যেতে পারত না।

মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের নিজ বাড়িতে লজিং রেখে পড়াশোনা করিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিতেন বিনামূল্যে। এ সকল মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ “হেড পন্ডিতের” সহধর্মিনী মোসাম্মৎ জাহানারা আহমেদ (মোসাম্মৎ জাহানারা আহমেদ ছিলেন মরহুম জসিম উদ্দিন মন্ডলের বড় মেয়ে) রান্না করতেন এবং সেই রান্না এত মজার হত যে, যারা খেতো তারা বলতো ‘কথায় কথা খায়,ব্যঞ্জনে খায় ভাত।’ ব্যঞ্জন অর্থাৎ তরকারি। তরকারি ভালো হলে ভাত বেশি খাওয়া হয়ে যায়। এখানে মরহুমা মোসাম্মৎ জাহানারা আহমেদের একটি গুণের কথা না বললেই নয়। মরহুমা মোসাম্মৎ জাহানারা আহমেদ স্বল্প শিক্ষিত হলেও, তিনি কোন ছোট টুকরো কাগজে কিছু একটু লেখা দেখলেই চুমু খেয়ে তা অতি যত্নে রেখে দিতেন যদি কোন দরকারি লেখা হয় এই মনে করে। লেখাপড়া এবং শিক্ষার বিষয়টি মরহুমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাধান্যের ছিল। এসব দরিদ্র মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই আজ দেশে ও বিদেশে পেশাগত ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছেন।

মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ “হেড পন্ডিত” ভূগোলে (Geography) এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর সময় ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে চেয়ে ছড়ির মাথা দিয়ে পিছনের ব্ল্যাকবোর্ডে পৃথিবীর মানচিত্র না দেখে কোন দেশ কোথায় তা দেখিয়ে বলে দিতেন। তার একজন ছাত্র বিদেশ থেকে চিঠি লিখেছিলেন এমনটি – ‘স্যার আপনি মানচিত্রে যে দেশগুলো দেখিয়ে আমাদেরকে ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন আজ আমি সেই দেশের প্রতিষ্ঠিত হয়েছি এবং চাকরি করছি (Norway)। তাই আপনার শিক্ষাদানের মূল্য আমার গায়ের চামড়া দিয়ে আপনার পায়ের জুতা বানিয়ে দিলেও ঋণ শোধ হওয়ার নয়।’ এই লেখা চিঠিটি এখনো হেড পন্ডিত সাহেবের বাড়িতে লোহার সিন্দুকের ভিতর সংরক্ষিত রয়েছে।

এছাড়াও মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ “হেড পন্ডিত” বাংলা ব্যাকরণেও এতটাই পারদর্শী ছিল যে তিনি ছোটবেলায় ছাত্রছাত্রীদের বাংলা ব্যাকরণ যেভাবে শিখিয়েছিলেন ওই শিক্ষাতেই অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন আর নতুন করে শিখতে হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তিনি যে ছয়টা কারকে একটা বাক্য শিখিয়েছেন, সমাস শিখিয়েছেন তাতেই পরবর্তীতে নতুন করে আর বাংলা ব্যাকরণ শিখতে হয়নি। ছাত্রছাত্রীর কাছে তিনি ছিলেন বাংলা ব্যাকরনের জাহাজ।

দরিদ্র এবং গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ নিজ দায়িত্বে একটি তহবিল গঠন করার উদ্যোগ নেন এবং পরে গ্রামের অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা সুবাদেই এই ‘Poor Fund’ তহবিলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই তহবিলের থেকে টাকা দিয়ে গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখার খরচ মেটানো হতো যা এখনো চলমান।

মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদের ভীষণ পছন্দনীয় এবং খুবই শখ ছিল ভুলকির মাছ ধরা। চলনবিল এলাকায় সেই সময় পানির নিচে ডুব দিয়ে জালের সাহায্যে মাছ ধরার প্রচলন ছিল। বর্ষাকাল শেষে পানি যখন কমতে শুরু করে তখন জমির মাঝখানে গোল করে বাঁশের ঘের দিয়ে একটা মুখ খোলা রেখে পানির মধ্যে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন তিনি। হঠাৎ করে কোন বড় মাছ হেলেদুলে আসতো, তখন মনে হতো যেন কোন দৈত্য দানব আসছে। বড় মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, শোল, গজার ইত্যাদি মাছ সেই বাঁশের ঘেরের মধ্যে ঢুকতো আর তখনই ঘেরের মুখটা বাঁশের তৈরি চাটাই দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে আস্তে আস্তে ঘেড়টাকে ছোট করে একসময় মাছটাকে ধরতে হত। এভাবে দীর্ঘক্ষণ পানিতে তাকিয়ে থাকার ফলে মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদের চোখের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল শেষ বয়সে।

আপাদমস্তক আদর্শবাদী শিক্ষক, সংগঠক, সর্বোচ্চ সংযমী ও ত্যাগী মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ- “হেড পন্ডিত” প্রায় ১৮ টি প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন তাঁর জীবনকালে।

মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমেদ “হেড পন্ডিত” ইন্তেকাল করেন ১৬ই মে ১৯৮৯ সালে।